ইতিহাস ও ঐতিহ্য

তিনদিক ভারত বেষ্টিত, মুহুরী, সিলোনিয়া, কহুয়া তিন নদীর পলিবাহিত প্রাচীন জনপদ পরশুরাম। অন্য সব জনপদের মতো পরশুরামের নামকরণের পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য। তবে এ নিয়ে এতদিন একাধিক মত থাকলেও কোনটির পেছনেই শক্তিশালী প্রমাণ ছিল না। অবশেষে এতদসংক্রান্ত দলিলপত্র উদ্ধার হয়েছে যা পরশুরামের নামকরণের ভিত্তি হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে। ইতিহাসের সূচনা লগ্ন হতে এ অঞ্চলের নাম খন্ডল ছিল বলে প্রাচীন তথ্যাবলী হতে প্রমাণিত। খন্ডল বিভিন্ন সময়ে ত্রিপুরা, বাংলার সালতানাত, মুঘল সাম্রাজ্য ইত্যাদির অধীনে ছিল। সময়ের বিবর্তনে খন্ডলের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বহুবার হাত বদল হলেও এর নাম অপরিবর্তিতই থাকে। এ অঞ্চলের স্বাধীন দেশপ্রেমিক বীর রাজা শমশের গাজীর সময়েও (১৭৪৮-১৭৬০) খন্ডল পরগনা হিসেবেই ইতিহাসে তথ্য মেলে। ইংরেজদের হাতে শমশের গাজীর পতনের পর ইংরেজ অফিসারগণ এ এলাকার শাসনকার্য নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। পরশুরাম নামকরণের পেছনে অত্রাঞ্চলে কয়েকটি জনশ্রুতি পাওয়া যায়। কারো কারো মতে হিন্দুদের অবতার পরশুরামের নামে এ নামকরণ হয়েছে। কিন্তু কোনরূপ সংশ্লিষ্টতা ছাড়া দেব-দেবীর নামে স্থানের নামকরণ হওয়ার নজির নেই।

আরেকটি মত হল, উত্তর বঙ্গের প্রাচীন জনপদ পুন্ড্রনগরের (বর্তমানে বগুড়ার মহাস্থানগড়) মধ্যযুগীয় রাজা পরশুরামের নামে নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু এই রাজার রাজ্য যমুনার পশ্চিম তীরেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাজা পরশুরাম খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (রা.) বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। রাজা পরশুরাম নিহত হবার শত শত বছর পরও খন্ডল হিসেবেই এ এলাকা পরিচিত হতে থাকে। সুতরাং ওই রাজার নামে খন্ডলের নাম পরিবর্তিত হয়ে পরশুরাম হয়েছে এ যুক্তি অবান্তর।

তৃতীয় মতটি হল, পরশুরাম উপজেলার দক্ষিণ কোলাপাড়া গ্রামে পরশুরাম সাহা নামে জনৈক ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার নামেই পরশুরাম বাজারের নামকরণ করা হয়। কিন্তু পরশুরাম বাজারের পত্তন ও নামকরণ হয়েছে অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং এই সময়ে কোলাপাড়ায় পরশুরাম সাহা নামে কোন ব্যক্তি ছিলেন বলে জানা যায়নি। পরশুরাম বাজারের নামকরণের পেছনে প্রাপ্ত একমাত্র প্রমাণিত মতটি হল, উপজেলার বাউর পাথর গ্রামে পরশুরাম চৌধুরী নামে এক বিত্তবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বীর রাজা শমশের গাজীর সমসাময়িক ছিলেন। তার বর্তমান বংশধরদের মতে তিনি ছিলেন তান্ত্রিক। তার নামেই পরশুরাম বাজারের নামকরণ হয়। (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ প্রকাশিত একটি অনুবাদ গ্রন্থে (চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা বৃত্তান্ত) উল্লেখিত তথ্যের স্বপক্ষে বিস্তারিত প্রমাণ রয়েছে।)

পরশুরাম বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত ফেনী জেলায় অবস্থিত একটি উপজেলা। বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম থেকে ১২০.১ কি.মি. এবং জেলা শহর ফেনী থেকে ২৫.১ কি.মি. দূরত্বে পরশুরাম উপজেলা অবস্থিত। পরশুরামের ভৌগলিক অবস্থান: ২৩০১০’ থেকে ২৩০১৭’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১০২৩’ থেকে ৯১০৩১’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং দক্ষিণে ফুলগাজী উপজেলা।

পরশুরাম ঐতিহাসিকভাবে ফেনী-নোয়াখালী-কুমিল্লা এর সমন্বয়ে গঠিত খন্ডল নামক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফেনী জেলার উত্তর প্রান্তে তিনদিকে ভারতের পাহাড়ি উচ্চভূমি বেষ্টিত পরশুরাম উপজেলা। ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চল এক সময় সমুদ্রবক্ষে নিমজ্জিত ছিল। ভূ-বিশেষজ্ঞ সুরেশ চন্দ্র দত্তের মতে, এ অঞ্চল প্রায় ৬০০০ বছর আগে সমুদ্রবক্ষ হতে জেগে ওঠে। তার এ মত অত্রাঞ্চলের সমতল অংশের জন্য মান্য হলেও পার্বত্য ত্রিপুরার কোলে অবস্থিত হওয়ায় পরশুরামের ভূ-ভাগ আরো প্রাচীন হওয়াই স্বাভাবিক। ভূমি গঠনের মতো পরশুরামের জনবসতিও ফেনীর দক্ষিণাঞ্চলের আগে শুরু হয়েছে। বেদ, পুরান ও মহাভারতের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করলে কমপক্ষে ৫৫০০ বছর আগে এ অঞ্চলে জনবসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে পরশুরাম অঞ্চল ত্রিপুরার সাথে যুক্ত ছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদগুলোর নামকরণের প্রাচীনত্ব নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য এখন আর পাওয়া না গেলেও পরগনা হিসেবে পরশুরামের এ যাবত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন নামটি হচ্ছে “খন্ডল।” ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় এর মালিকানা অনেকবার পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায়। গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের শাসনকালে খন্ডলকে তার সালতানাতের অংশ হিসেবে জানা যায়। খন্ডল দখলে বারবার ব্যর্থ হয়ে ত্রিপুরা রাজা ধন্যমাণিক্য খন্ডলের বারজন বশিককে (স্থানীয় শাসনকর্তা) নিমন্ত্রণ করে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর নিয়ে যান। সেখানে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আহার গ্রহণের মুহূর্তে বারজন বশিককে ত্রিপুরার সৈন্যরা হত্যা করে। পরবর্তীতে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সেনাপতি হামজা খাঁ পুনরায় খন্ডল দখল করেন। এ সময় ত্রিপুরা রাজা হামজা খাঁকে আক্রমণ করার জন্য দক্ষিণে সৈন্য প্রেরণ করলে হামজা খাঁ সৈন্যবাহিনী নিয়ে বর্তমান পরশুরাম বাজারের উত্তর পাশে বিশাল খন্দক (পরিখা) খনন করে ত্রিপুরা বাহিনীকে প্রতিহত করেছিলেন। ওই খন্দক বেষ্টিত জনপদটি এখনও খন্দকিয়া নামে পরিচিত। পরবর্তীতে পরিখার সাথে কহুয়া নদীকে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বাংলার নবাব সুজাউদ্দিনের সময় খন্ডলকে আবার বাংলার করদ অঞ্চলরূপে পাওয়া যায়। সুজাউদ্দিনের সময়ে বৃহত্তর কুমিল্লা, খন্ডল ও দক্ষিণশিক (বর্তমানে ছাগলনাইয়া উপজেলা) অঞ্চলের নাম ছিল চাকলা রৌশনাবাদ। রৌশনাবাদ-ত্রিপুরার দেশপ্রেমিক, প্রজাদরদী রাজা, ভাটির বাঘ খ্যাত বাংলার বীর শমসের গাজীর সময়ে (১৭৪২-৬০) খন্ডল তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সময় খন্ডলের জমিদার ছিলেন কালু সিং। তিনি বিভিন্ন সমরাভিযানে শমশের গাজীকে সহায়তা করতেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। দখলদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসময় অথচ বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে বীর কেশরী শমশের গাজীর পতনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারেরা এ অঞ্চলের শাসন কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন র‌্যালফ লীক উল্লেখযোগ্য। এ অঞ্চলের দরিদ্র কৃষক-প্রজাদের উপর নির্যাতনকারী হিসেবে তার খ্যাতি থাকলেও ছাগলনাইয়া থেকে খন্ডল তথা পরশুরাম হয়ে চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে তিনি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। এ সড়কটি ক্যাপ্টেন লীক রোড নামে পরিচিত। ইংরেজ অফিসার ক্যাপ্টেন লীক অত্র এলাকার প্রশাসক নিযুক্ত হওয়ার পর ১৭৮০ সালের দিকে পরশুরাম বাজারের পাশে একটি পুলিশ চৌকি স্থাপন করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। সুতরাং তখন অত্র এলাকা খন্ডল পরগনা হিসেবে অভিহিত হলেও পরশুরাম বাজারের অস্তিত্ব প্রথম জানা যায়। ক্রমান্বয়ে এই পুলিশ চৌকি ১৮৮০ সালে পূর্ণাঙ্গ থানায় রূপান্তরিত হয়। যোগাযোগ সুবিধার কারণে এটি ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এ ফলশ্রুতিতে এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে এটি প্রশাসনিক থানা ও ১৯৮৫ সালে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। এ অঞ্চলে শহর এলাকার পূর্ণাঙ্গ নাগরিক সেবা ও পরিকল্পিত নগরায়নের উদ্দেশ্যে ২০০১ সালে পরশুরাম পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হলে, পরশুরাম আনুষ্ঠানিকভাবে পৌরশহরের মর্যাদা লাভ করে।

পরশুরামের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে “বিলোনিয়ার ট্রেন” ফেনী জেলার উত্তরাঞ্চলের জনগোষ্ঠির মহকুমা সদরের সাথে যাতায়াতের পাশাপাশি ত্রিপুরার বিলোনিয়া হয়ে বাংলাদেশের বিলোনিয়া দিয়ে ফেনী থেকে আসামের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৯২৯ সালে এ রেলপথ চালু করে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে এ রেললাইনের কাজ সম্পন্ন হয়।

প্রথমদিকে এ লাইনে মালবাহী ট্রেন চলাচল করলেও ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভাগের পর দুটি লাইন আলাদা হয়ে যায়। ভারতের অংশে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলেও পাকিস্তান অংশে বিলোনিয়া থেকে ফেনী মহকুমা শহরের সাথে যোগাযোগের জন্য একটি যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করা হয়। সে সময় ফেনীর উত্তরাঞ্চলের মানুষের মহাকুমা শহরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল এ রেলপথ। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর রেল যোগাযোগের পাশাপাশি সড়ক যোগাযোগের উন্নতি হওয়ায় কদর কমে যায় এ রেলপথের। ব্যাপক লোকসানের কারণে ১৯৯৭ সালের ১৭ আগস্ট কর্তৃপক্ষ ফেনী-বিলোনিয়া রেলপথ বন্ধ ঘোষণা করে।